ময়না বিবি |গল্প Golpo|Moyna Bibi|Story |

                       ময়না বিবি

         


ময়না বিবি ওরফে ময়না খাতুন। বয়স কত হবে, ৮০, ৯০। আমি সঠিক জানি না। ছোট খাটো খটখটে বয়স্ক মহিলা। কথা বলে বেশি।মানুষ কে খুব ভালোবাসে, খুব সহজেই আপন করে নেয়।এই বয়সে এসেও সে অনেক স্ট্রং এখনো। বয়স বুঝা যায় না। এমন কিছু মানুষ থাকে না যাদের চেহারায় একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব থাকে। সহজেই বয়স অনুমান করা যায় না। ময়না তাদের মতোই একজন। গ্রামের সম্পর্কে দাদী আমার


আজ সকালে ময়না দাদীকে দেখে হোঁচট খাইলাম। একি অবস্থা হয়েছে তার।চেনায় যাচ্ছে না আর।হাতে লাঠি। গোলগাল মুখটা ফোলা ফোলা ভাব। এক ঝটকায় বয়স বেড়ে গেছে। অজান্তেই বলে ফেললাম ময়নার অবস্থা তো এবার শেষ। বুকের মধ্যে ছ্যত করে উঠলো তার অসহায় মুখটা দেখে।কাছে ছুটে গেলাম। হাত টা ধরলাম। আমাকে কাছে যেতেই কান্না করতে করতে আমার হাত ধরলো। চেয়ারে বসায়ে জিজ্ঞেস করলাম, এমন অবস্থা কিভাবে হলো? পড়ে গিয়েছিলে? স্ট্রোক করেছিলে?হাত নেড়ে নেড়ে যা বললো, বুঝলাম না। শুধু এইটুকু বুঝলাম দুই মাস থেকে এই অবস্থা।


 ময়নারা গরীব মানুষ। গ্রামের এক বাড়িতে কাজ করে। শুনেছি তারা উনাকে অনেক সমাদর করে রাখে। এই অবস্থায় কে তার দেখা শোনা করছে? বললো ছেলের বউ। শুনে ভালো লাগলো। আশ্বস্ত হলাম। 


ময়নার জন্য আজ আমার এতো খারাপ লাগছে কেন? হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ময়নার সময় শেষ হয়ে আসছে। নিজেকে ময়নার জায়গায় দাড় করিয়ে ভাবছি পরকালের কথা। বুক ফেটে কান্না আসছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিচ্ছি।বারবার মনে হচ্ছে আমার তার কাছে মাফ চাওয়া উচিৎ। এটাই সুযোগ। আর সুযোগ নাও পেতে পারি। হয়তো আল্লাহ তাআলা ময়নাকে নিজের পায়ে আমার কাছে পাঠিয়েছে যাতে আমি মাফ চাইতে পারি। এইসব চিন্তা ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।


খাবার খেতে বললাম। বললো খেয়ে এসেছি। বিস্কুট দিলাম,আমার অনুরোধে দুই টা খাইলো। আচ্ছা, ময়নাকে আমি কেন আজ এতো ভালবাসছি? কেন তার জন্য আমার হৃদয় জুড়ে একটা হাহাকার অনুভব করছি?অথচ এই ময়নাকে আগে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেই আমি কিছু টা বিরক্ত হয়ে সরে যেতাম। যাতে আমাকে দেখলেই কথা বলতে আসতে না পারে। সত্যি বলতে আমি তার অতিরিক্ত কথা থেকে বাঁচতে লুকাতাম। সে যতক্ষণ থাকতো ঘর থেকে বের হতাম না। আমাদের বাড়ির সবাই জানতো ব্যাপার টা।আমি তাঁকে দেখে লুকাতাম আর সে আমাকে খুঁজে বেড়াতো।


সবাই হাসতো ব্যাপার টা নিয়ে। ঠাট্টা করে বলতো ঐ দেখ ময়না এসেছে। আমি তাকে এড়িয়ে যেতাম আর সে আমার কাছেই এগিয়ে যেত এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতো। মাঝে মাঝে বলেই ফেলতাম, এই ময়না আমি কিন্তু বেশি কথা পছন্দ করি না। এতে ময়না আরো আমার কাছে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরার মতো করে বলতো কেন বোন, তোমার ভালো লাগে না কেন? 😊


এমনি একদিন আমের সময়। ময়নাকে দেখে আমি ঘরের দিকে হাঁটা দিছি। ময়না আমারে ডাকে আর আমি বলি তুমি যার কাছে এসেছো তার সাথে কথা বলো আমাকে বিরক্ত করো না। তখন ময়না বিবি একটা শপিং ব্যাগ আমার দিকে বাড়িয়ে বলে, আমার সাথে এমন করিস কেন দিদু, আমি তোর জন্য আম নিয়ে এসেছি। সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। সেই সাথে খুশিও। বুঝেছিলাম ময়না দাদি আমাকে অনেক ভালবাসে।


ময়না প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে তার বাবার কিছু জমি তার এক আত্মীয় নিজের বলে অন্য জনের কাছে বিক্রি করেছে। আত্মীয় বেঁচে নেই। জমিটার ময়নারাই আসল মালিক। কিন্তু যার কাছে আছে সে দখল করে আছে। তাই আদালতে মামলা করেছে ময়নারা কয় বোন মিলে। ময়নার মিষ্টি কথা এবং অভাব অনটনের কথা শুনে আইনজীবী এবং মুহুরী কেউ টাকা নেই না বলে শুনেছি। তাঁকে খুব ভালোও বাসে।উকিল সাব তাঁকে মা বলে ডাকে।


আজও ময়না এসেছিল সেই জমির খোঁজ নিতে। উকিলের নাম্বার নিতে। বাবা বাড়ি ছিল না। 

ময়না আমি মুখোমুখি বসে আছি। আগের মতো আর বেশি কথা বলছে না। কথা বলার ইচ্ছে আছে কিন্তু শরীর আর নিতে পারছে না। কিছুক্ষণ ময়নার দিকে চেয়ে থেকে বললাম -দাদি আমার আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে মাফ করে দাও।কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল আর এলোমেলো ভাবে কিছু বলার চেষ্টা করল। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। চোখের পানি লুকাতে অন্য দিকে মুখ ফিরে বসে আছি।


কিছু সময় পর ঘুরে দেখি ময়না দাদি চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। উঠে গিয়ে তাকে নামতে সাহায্য করলাম। তার যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে আছি আর ভাবছি এভাবে ময়না কতদিন বাঁচবে নাকি তার সময় শেষ হয়ে এসেছে? 


দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম -ময়না খাতুন আবার এসো 

ময়না বিবি কোন উত্তর দিল না, ঘুরেও তাকালো না, সে তখন তার টলমলে শরীর টা কে সামলে নিয়ে লাঠির সাহায্যে সামনে এগিয়ে গেল। 



Written by this blogger

No comments

Powered by Blogger.